সেক্রেড হার্ট জুনিয়র হাই স্কুলের ইতিহাস ও কৃতিত্বঃ
ভূমিকাঃ যশোর ক্যাথলিক মিশনে সিস্টারস অব চ্যারিটি সম্প্রদায়ের সিস্টারদের আগমন ও তাঁদের কার্যক্রমঃ ১৮৬৩ খ্রীস্টাব্দে প্রথম সিস্টারগণ ভারতের কৃষ্ণনগর সেন্টার থেকে যশোরে আসেন। যশোরের আবহাওয়া, পানীয় জলের অভাব এবং এদেশী খাদ্য সহ্য করতে না পেরে ইটালিয়ান সিস্টারগণ অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং অকালে ঝরে যান একের পর এ বেশ কয়েকজন। ফলে তাঁরা কৃষ্ণনগরেই অবস্থান করতে বাধ্য হন। অনেকে মারা যাওয়া সত্ত্বেও সাহসী সৈনিকের মত ১৮৬৪ খ্রীঃ পুনরায় যশোর এসে সিস্টারগণ কাজ করতে শুরু করেন। তাঁদের কাজ ছিল গ্রামেগঞ্জে ঘুরে ঘুরে লোকদের দেখা-গুনা করা, রোগীদের ঔষধ দেওয়া, বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের সেবা করা; ছোট ছেলেমেয়েদের ধর্মীয়, নৈতিক ও স্বাস্থ্য সম্বন্ধীয় শিক্ষা দান করা। সিস্টারস অব ট্যারিটি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাত্রী সাধ্বী বার্থলোমেয়া কাপিতানিও ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষিকা। তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সিস্টারগণ তাঁদের সেবার হাতকে প্রসারিত করেন শিক্ষা ক্ষেত্রে।
স্কুল শুরু: সেক্রেড হার্ট জুনিয়র হাই স্কুল যশোর শহরের অন্যতম একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ শহরের প্রাণকেন্দ্র পুরাতন কসবার প্রকৃতির ছায়াঘেরা মনোরম পরিবেশে চারতলাবিশিষ্ট সুরম্য ভবনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ছেলেমেয়েদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষাদান করে আসছে। আর্তমানবতার সেবায় নিয়োজিত “সিস্টারস্ অব চ্যারিটি” সম্প্রদায়ের সিস্টারগণ তাঁদের সেবার হাতকে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রসারিত করে এ প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলেন। তদানিন্তন সময়ে যশোর শহরে কর্মরত ব্রিগেডিয়ার বেগ নামের একজন আর্মি অফিসারের শিক্ষা জীবন কাটে করাচীতে সিস্টারদের
পরিচালিত একটি মিশন স্কুলে। স্কুলের পরিবেশ, পদ্ধতি, সার্বিক ব্যবস্থাপনা এবং বিশেষভাবে সিস্টারদের অনিন্দনীয় আচার-আচরণে তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত হন। নিজেদের সন্তানদেরও অনুরূপ শিক্ষায় গড়ে তোলার প্রয়াসে সে সময়ে যশোরে অবস্থানরত সিস্টারদের অনুরোধ করেন একটি স্কুল খোলার জন্য। এ সময় সিস্টারদের অবস্থান ছিল ফাতিমা হাসপাতালের পাশে একটি ছোট, সাধারণ ঘরে এবং তারই সংলগ্ন একটি কামরায় আর্মি অফিসারদের মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছেলে মেয়েকে ইংরেজী মাধ্যমে শিক্ষাদান করতে শুরু করেন রেভাঃ সিস্টার সিলভিয়া মাগদো। কিছুদিনের মধ্যেই এলাকার মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে স্কুলটির কার্যক্রমের সফলতা- অনুরোধ আসতে থাকে বাংলা মাধ্যম খুলে স্কুলটির কলেবর বৃদ্ধির জন্যে। জনগণের অনুরোধ এবং প্রয়োজনের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে ১৯৫৩ সালের ২৬শে জুলাই ইংরেজী ও বাংলা উভয় মাধ্যমে সূচনা হয় সেক্রেড হার্ট স্কুলের আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম। তখন ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ২২৫ জনে এবং ক্লাশ শুরু হয় শিশু থকে ৪র্থ শ্রণী পর্যন্ত। ছাত্র-ছাত্রীরা অধিকাংশই ছিল ইংলিশ এবং এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব অর্পণ করা হয় রেভাঃ সিস্টার সিলভিয়া মাচাদোর উপর। তিনি অতি দক্ষতার সাথে তার সেবামূলক দায়িত্ব পালন করেছেন সম্ভবত দীর্ঘ ১৪ বছর। অন্তরে গভীর শোক নিয়ে মেনে নিতে হচ্ছে যে, “Man proposes but God disposes” গর্বভরে আমার লেখায় উল্লেখ করতে চেয়েছিলাম যে তিনি স্কুলের সুবর্ণ জয়ন্তী উৎসবে অংশগ্রহণ করে আমাদের ধন্য করবেন। প্রথম প্রধান শিক্ষিকা আজও জীবিত আছেন। কিন্তু গত ২রা সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৮.৩০ মিঃ টেলিফোনের মাধ্যমে জানতে পারলাম যে তিনি মাত্র ২ ঘন্টা পূর্বে, সন্ধ্যা ৬.৩০ মিঃ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
ঈশ্বর তাঁর সকল পাপ ও দুর্বলতা ক্ষমা করে তাঁকে অনন্ত শান্তিদান করুন। তিনি ছিলেন ব্যাঙ্গালোরে (ভারতে) আমাদেরই এক কনভেন্টে। ১৯৫৩ সাল থেকে যারা প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেছেন-
১. রেভাঃ সিস্টার সিলভিয়া মাচাদো ১৯৫৩-১৯৬৭
২. রেভাঃ সিস্টার রীতা লুপী ১৯৬৮-১৯৭০
৩. রেভাঃ সিস্টার বার্থলোমেয়া হালদার ১৯৭০-১৯৭৩
৪. রেভাঃ সিস্টার এনরিকা কস্তা। ১৯৭৪-১৯৭৬ জুন
৫. রেভাঃ সিস্টার তেরেজা কস্তা ৭. রেভাঃ সিস্টার রজা ডি কস্তা ১৯৮৩-১৯৯২ জুন
৬. রেভাঃ সিস্টার মেটিল্ডা মন্ডল ১৯৭৭-১৯৮২
৮. রেভাঃ সিস্টার তেরেজা কস্তা ১৯৯২ জুলাই-২০০৩- ১৯৭৬ জুলাই-১৯৭৭ জুন
পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের দাবী সর্বত্র মাতৃভাষা বাংলা চালু এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্কুলের ইংরেজী মাধ্যম তুলে দিয়ে শুধুমাত্র বাংলা মাধ্যমের স্কুল কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। তবে বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত বই-এর পাশাপাশি অতিরিক্ত ইংলিশ বই প্রতি শ্রেণীতে পড়ানো হয়- ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার মানের ভিত্তি মজবুত রাখার উদ্দেশ্যে। বর্তমানে স্কুলে নার্সারী থেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত দশটি শ্রেণীতে মোট ২৫টি শাখা চালু রয়েছে। যার ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১৪০০ (এক হাজার চারশত) জন। শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ৩০ জন এবং ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীর সংখ্যা ৮ জন। উল্লেখ্য যে, ১৯৬৮ সালে
চারতলা বিশিষ্ট স্কুল ভবনটির প্রতি তলায় ছেলেমেয়েদের জন্য রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে আলো ও পাখার ব্যবস্থা, প্রতি তলাতে রয়েছে টয়লেট সুবিধা। খেলাধুলার জন্য রয়েছে খেলার মাঠ এবং নিরাপত্তার জন্য রয়েছে সুদীর্ঘ উঁচু প্রাচীর, প্রধান গেটে সার্বক্ষণিক দারোয়ান ব্যবস্থা। গেটের পাশে রয়েছে অভিভাবকদের বিশ্রাম কক্ষ এবং প্রাচীর সংলগ্ন ছোট বাগান। সেক্রেড হার্ট জুনিয়র হাই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রতি বছর প্রাইমারী ও জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বৃত্তি লাভ করছে। ২০০২ সালের প্রাইমারী বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ৫ জন ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করেছে। এ ছাড়া বিগত বছরগুলোতে উভয়
আজকের প্রতিযোগিতার বিশ্বে ছেলেমেয়েদের পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজন পুঁথিগত বিদ্যাশিক্ষার পাশাপাশি জ্ঞান বিজ্ঞান, খেলাধুলা, স্কাউটিং এবং সংস্কৃতিচর্চা। সে কারণে স্কুলে পুঁথিগত বিদ্যাশিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য কাজগুলি শেখার ও প্রকাশের সুযোগ করে দিচ্ছে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে। প্রতি বছর স্কুলে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা ও পুরস্কার বিতরণ, নাট্যানুষ্ঠান, অভিভাবক দিবস, কার দিবস, বৃক্ষ রোপণসহ জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়ে থাকে। এছাড়া সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে লাইব্রেরী ক্লাসের মাধ্যমে বই পড়া, সাংস্কৃতিক ক্লাসের মাধ্যমে নাচ, গান, কবিতা, গল্প, বক্তৃতা, জ্ঞান বিজ্ঞান, বিতর্ক, চিত্রাংকন, নাটক, কাব ক্লাসের মাধ্যমে কাবিং এবং নীতিশিক্ষা ক্লাসের মাধ্যমে নৈতিকতা সম্পর্কে শেখার এবং প্রকাশের সুযোগ পেয়ে থাকে। এরই প্রকাশ হিসেবে বাংলাদেশ পিপলস থিয়েটার এসোসিয়েশন আয়োজিত ১৯৯৫ সালে প্রথম জাতীয় শিশু নাট্য উৎসব এবং ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ও পিপলস থিয়েটার এসোসিয়েশন যৌথভাবে আয়োজিত ঢাকাতে তৃতীয় জাতীয় শিশু নাট্য উৎসবে ৪৫ দলের মধ্যে একমাত্র স্কুল দল হিসেবে অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের সাক্ষর রাখে। এছাড়া ২০০০ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনের আমন্ত্রণে টেলিভিশন থেকে প্রচারিত শিশু কিশোরদের মঞ্চ নাটক অনুষ্ঠান “কিশোর মঞ্চ” নামের অনুষ্ঠানে স্কুলের একটি দল নাটক পরিবেশন করে সুনাম অর্জন করে।
বাংলাদেশ স্কাউটস্ দেশের প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কাউটিং এর কাব শাখাকে অধিক গুরুত্ব প্রদানের জন্য ১৯৯৬ সাল থেকে এর অন্যান্য শাখার মত জাতীয় পর্যায়ে “রাষ্ট্রপতি এ্যাওয়ার্ডের” মত কাবদের সর্বোচ্চ এ্যাওয়ার্ড, “শাপলা কাব এ্যাওয়ার্ড” প্রবর্তন করেছে। সেক্রেড হার্ট স্কুলের কাবেরা তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার মাধ্যমে ১৯৯৬ সালে এ অঞ্চলের সর্বপ্রথম ২ জন এবং দেশের দ্বিতীয় ব্যাচে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে “শাপলা কাব এ্যাওয়ার্ড” গ্রহণ করে। এ বছর শাপলা কাব এ্যাওয়ার্ড প্রার্থী ১৩ জন ছেলেমেয়ে জাতীয় পর্যায়ের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির অপেক্ষায় রয়েছে। স্কুলটি ১৯৯৭ সালে শ্রেষ্ঠ কাব দল হিসেবে ও শ্রেষ্ঠ কাব শিক্ষক হিসেবে অঞ্চল কর্তৃক স্বীকৃতি লাভ করে। এছাড়া ২০০২ সালের জাতীয় শিক্ষা
সপ্তাহের জেলা পর্যায়ে- স্কুলের শিক্ষক শীতল মিত্র শ্রেষ্ঠ স্কাউট লিডার হিসাবে পুরষ্কার লাভ করেন। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় স্থান অধিকার করে সুনাম
অর্জন করছে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মান উন্নয়ন ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সরকারী বেসরকারী সংস্থা আয়োজিত বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়াম এবং প্রশিক্ষণ কোর্সে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাবৃন্দ অংশগ্রহণ করে থাকে।
বিভিন্ন সময়ে দেশের বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ, মন্ত্রীবর্গ, শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ সেক্রেড হার্ট স্কুলটি পরিদর্শনে এসে সন্তোষ প্রকাশ করেন। “সেক্রেড হার্ট” নামের এই শিক্ষায়তনটি ১৯৫৩ সালে জাতি গঠনের ব্রত নিয়ে যাত্রা শুরু করলে আজ এর বয়স পূর্ণ হলো ৫০ বছর। সার্থক হোক প্রতিষ্ঠাতা, নিবেদিতপ্রাণ সিস্টারদের স্বপ্ন। যুগ যুগ ধরে আরও অগণিত মানুষএই পবিত্র হৃদয়ে স্থান পাক এবং এর অসীম ভালবাসা উপলব্ধি করুক, বেড়ে উঠুক জীবনের উচ্চ শিখরে।
সিস্টার ভেরনিকা যমুনা রোজারিও
প্রধান শিক্ষক